ঘুরে দাঁড়াতে বিএনপির কৌশল পরিবর্তন


deshlive প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৫, ২০২৪, ৮:১১ পূর্বাহ্ন /
ঘুরে দাঁড়াতে বিএনপির কৌশল পরিবর্তন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনেকটা হতাশায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাই কৌশল পরিবর্তন করে ফের ঘুরে দাঁড়াতে চায় দলটি। দীর্ঘদিন ধরে চলা সরকার পতন আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় দলটির অভ্যন্তরে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। বিগত ১৫ বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে সংগঠন পুনর্গঠন ও দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের বিষয়ে নজর দলটির। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতায় ভিন্নতা আনা হচ্ছে। পূর্বমুখী কূটনীতি জোরদারের পাশাপাশি পশ্চিমের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক চায়। এজন্য বিদেশবিষয়ক কমিটিও (ফরেন অ্যাফেয়ার্স) ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ভৌগোলিক সীমানা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ‘ডেক্সভিত্তিক উইং’ গঠনের কথাও ভাবছে দলটির হাইকমান্ড।

এছাড়া নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে নীরবে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। দলকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা, নিজেদের দাবির পক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত তৈরি এবং সংগঠনকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে নানাভাবে কাজ করছেন নেতারা। একই সঙ্গে আন্দোলনও চালিয়ে যেতে চায় দলটি। তবে আপাতত জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি ঘিরে এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর অবস্থানও পর্যালোচনা করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে দলটি বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে ভারত, চীন ও রাশিয়া সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ করেছে। এসব পরাশক্তির সঙ্গে আগামী দিনে বিএনপির সম্পর্কের নীতি কী হবে তা নিয়ে ভাবছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

এছাড়া দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর দলের শীর্ষ পর্যায়ে এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হচ্ছে। চলতি বছরেই দলের কাউন্সিল করার কথা চলছে। তা জুন-জুলাইয়ের মধ্যেও হতে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যে কোনো বড় আন্দোলনে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে। এবারের আন্দোলনও তার বাইরে নয়। এরমধ্যেও অনেকেই দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। পুনর্গঠনের মাধ্যমে এসব বিষয়ের মূল্যায়ন করা হবে।

অতীত অভিজ্ঞতায় কৌশল নির্ধারণ : অতীত অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করছে বিএনপি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে সফল হয়নি তারা। আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বিএনপি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উপলব্ধি হয়েছে যে বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শুধু রাজপথে সক্রিয় থেকে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়েছে। এমন বাস্তবতায় রোজার ঈদের পর দলীয় কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে তা শুরু করবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কেউ কেউ প্রথমে সাংগঠনিক সংস্কার শুরু করার কথা বলছেন। অনেকে মনে করেন, আগে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা দরকার। এর ভিত্তিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা উচিত।

দল পুনর্গঠন ও কাউন্সিলে নজর : নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দল পুনর্গঠন ও কাউন্সিলের বিষয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তারা ১ মার্চ বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি পুনর্গঠন করেছেন। বাকি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনও পুনর্গঠন করে ঢেলে সাজাতে চান। অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে মূল দল বিএনপির সাংগঠনিক নেতৃত্বে পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলীয় কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার, প্রভাবশালী দেশগুলোর ক্ষেত্রে অবস্থান ঠিক করবে : পরাশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে হবে বলে মনে করছেন দলের সিনিয়র নেতারা। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতায় ভিন্নতা আসতে পারে। দলটির বিদেশ বিষয়ক কমিটিকেও (ফরেন অ্যাফেয়ার্স) ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিদেশবিষয়ক কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যানের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়। এজন্য বর্তমান চেয়ারম্যানকে রেখেই বিদেশ বিষয়ক কমিটিতে নতুন করে কূটনীতিতে অভিজ্ঞ একজনকে সদস্য সচিব করা হতে পারে। এছাড়াও এ কমিটির আওতায় দক্ষিণ এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ভৌগোলিক সীমানা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ‘ডেক্সভিত্তিক উইং’ গঠনের কথাও ভাবছে। এসব উইংয়েও অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়া হবে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রমতে, নির্বাচনের পর চীনসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। ওই আলোচনা থেকে দলটির নেতাদের মনে হয়েছে, বিএনপির বিষয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বিএনপিও পূর্বমুখী কূটনীতি জোরদার করতে আগ্রহী। এছাড়া বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে বলে দলটির নেতারা মনে করছেন। সেজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই ভারতের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনেকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সমালোচনার মনোভাব ধরে রাখার পক্ষে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে মত দিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিএনপি নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে চায়। পশ্চিমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা দূরত্ব আছে তা কাটিয়ে তোলার পরিকল্পনা আছে দলটির। মূলত পর্দার আড়ালে কৌশলগত আলোচনাকে এখন বেশি প্রাধান্য দেবে বিএনপি।

নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে নানা পদক্ষেপ : কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সাধ্যমতো সব সাংগঠনিক জেলায় ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে। পাশাপাশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনও করছে। এতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিদিন ভার্চুয়ালি একাধিক ইফতারে অংশ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার এই বক্তব্য শুনে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছেন। এছাড়াও ইফতারে একে অন্যের সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টিও নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। শুধু জেলা পর্যায়ে নয়; উপজেলা, পৌর, থানা ও ইউনিয়নেও ইফতারপূর্ব আলোচনা সভা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উপজেলা পর্যায়ের ইফতারেও ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন।

থাকবে ইস্যুভিত্তিক জনসম্পৃক্ত আন্দোলনেও : চলতি বছরে বড় কোনো আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই বিএনপির। তবে ইস্যুভিত্তিক জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি বাড়ানো হবে। এজন্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়লেও কর্মসূচি দেওয়া হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সামনে গরমকাল আসছে। এ সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে। তখন কর্মসূচিও বাড়ানো হবে। তবে সব কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। বিএনপি নেতারা জানান, ঈদের পর যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে যুগপতের কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এখন যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি না থাকলেও শরিকদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ আছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাচন হয়ে গেল মানেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ যে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখল করে আছে তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন চলবে। কেননা দেশের ৯৫ ভাগেরও বেশি ভোটার নির্বাচন বর্জন করেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় দল হিসাবে বিএনপির দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকার ও দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

দেশ লাইভ/স্বজন