শিশু-কিশোরদের অনলাইন আসক্তি ক্ষতিকর


aasohan প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১৩, ২০২৪, ৬:০৩ অপরাহ্ন /
শিশু-কিশোরদের অনলাইন আসক্তি ক্ষতিকর

দেশলাইভ ডেস্ক: শৈশবকাল হলো একটা মানুষের জীবনের প্রথম স্তর। আর এ শৈশব শব্দটি শুনলে মনের মধ্যে একটি ভালো লাগার অনুভূতি জেগে ওঠে। শিশুরা আমাদের খুব আদরের। অথচ শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। ইন্টারনেটের আগ্রাসী ছোঁয়ায় আজ অনেক মানুষ বিপর্যস্ত। তবে এর ভয়াবহতার শিকার প্রধানত অল্প বয়সি শিশু ও কিশোররা।

বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জীবনে গতিময়তা আনা সম্ভব নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি তার খারাপ দিকও আছে। তবে এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সজাগ থাকা খুবই জরুরি। ইন্টারনেট মানবসভ্যতার একটি বিস্ময়কর অবদান। বর্তমান প্রজন্ম অতিদ্রুত এই প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হচ্ছে। এক দুই যুগ আগেও শিশু-কিশোরদের খেলার সাথি ছিল পাড়া-প্রতিবেশীদের সন্তান, নানা ধরনের মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল।

হরেক রকমের খেলা খেলে পার করত নিজেদের সৌন্দর্যের শৈশব-কৈশোরকাল। বর্তমান সময়ে শিশুদের খেলার সাথি কার্টুন, মিনা রাজু, গোপাল বার্ট ইত্যাদি। শিশু কান্না করলে সান্ত¡না দেওয়ার সহজ পন্থা হলো বাবু তুমি কান্না করোনা, তুমি টিকটক গোপাল বার্ড, মিনা রাজু দেখো। শিশুর পড়ার বয়সে আত্মঘাতী অনলাইন জগতে আসক্ত করলে তার মেধা কাজ করবে কোন দিকে? তার পড়ার মেধা তো এই অনলাইনের মধ্যে ব্যয় করে। ফলে শিশু একটা সময় অনলাইনে আসক্ত হয়ে যায় আর পড়তে চায় না। পড়লেও পড়া মনে থাকে না।

তার মন-মানসিকতা সব সময় অনলাইনের দিকে আসক্ত থাকে। শিশুকাল হলো মানুষের জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপ। এখান থেকে তার হাতেখড়ি শুরু হবে। তা না হলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর অনলাইনে আসক্তি হয়ে শিশু-কিশোররা ভবিষ্যতে মেধাশূন্যে জাতির পথে অগ্রসর হচ্ছ। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবাধ তথ্যসম্ভারে বিচরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের চিন্তা, জ্ঞানের পরিধি ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারছে ঠিক।

তবে এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না থাকায় নানা ধরনের বিপদে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় হয়তো সে একটা ভালো পেজে আছে, তার মাঝেমধ্যে অনেক ধরনের অনেক বিজ্ঞাপন এবং অনেক খারাপ পেজগুলো আসে, যার কারণে তার বয়সের তাড়নায় নিজেদের ভালো-মন্দের জ্ঞান না হওয়ায় ওই সাইটগুলোতে সে বিচরণ করে। এমন খারাপ সাইটগুলোতে বিচরণ করতে করতে একটা সময় এই সাইটগুলোর প্রতি এবং অনলাইনের ওপর আসক্ত হয়ে পড়ে। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ শিশু-কিশোর ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন নতুন পেজের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা সব সময় খাতা-কলম-বই কিন্তু সে বয়সে তাদের হাতে থাকে মোবাইল, লেপটপ অনলাইন জগতের উপকরণ।

শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই অনলাইনে জগতে আসক্ত হয়ে কোনো সময় দিন গিয়ে রাত আসে, রাত গিয়ে দিন আসে খবর থাকে না। তাদের নিয়মিত খাবার খাওয়া হয় না। যার ফলে তারা নানা ধরনের পুষ্টিহীনতায় ভোগে। শরীর দুর্বল থাকে।

অনলাইনে আসক্ত শিশু-কিশোররা কারো সঙ্গে কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করতে পারে না। কারো সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারে না, মিশতে পারে না। তারা সব সময় একরোখা থাকে। শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার জ্ঞানচর্চা করা কিন্তু তারা অনলাইনে আসক্ত হয়ে বইয়ের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে।

যেখানে শিশু-কিশোররা হবে জ্ঞানপিপাসু, জ্ঞান অন্বেষণের জন্য মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে বেড়াবে, নানা রঙের নানা জ্ঞানের বই পাঠ করে নিজের মস্তিষ্ককে করবে আরো উর্বর, নিজেকে করবেন আরো সমৃদ্ধ। সেখানে তারা মোবাইলের টাচ স্ক্রিন আর লেপটপের মনিটরে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন। সারা দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।

ইন্টারনেটে নিরাপত্তা নিয়ে শিশুরা কীভাবে, তাদের পরিস্থিতি কী- এসব জানতে ইউনিসেফ সারা দেশে এ জরিপ চালায়। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি ১১ হাজার ৮২১ ছেলেমেয়ে জরিপে অংশ নেয়। ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওই জরিপে বলা হয়- বাংলাদেশের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ শিশু-কিশোর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন সময় কাটায়। এদের ৯০ শতাংশই মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

একটি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা কোনো না কোনো ধরনের প্রযুক্তিগত পর্দার সামনে ব্যয় করেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক বেড়েছে ২০ লাখ। শিশু-কিশোররা ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা সাইবার অপরাধের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়ে যায়।

বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৬০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে।

ছদ্মবেশে বখাটেপনা, ইভটিজিং করা ইত্যাদি থেকে শুরু করে সামাজিকমাধ্যমে অহরহই হচ্ছে হ্যাকিং ঘটছে ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনাও। এর ফলে দেশে ক্রমেই বাড়ছে সাইবার অপরাধ। বেসরকারি জরিপে দেখা যায়, প্রতি ২০ সেকেন্ডে এ ধরনের একটি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি থেকে শুরু করে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থীর একই ব্যক্তির দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া অথবা অনলাইনে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে মাদক, অস্ত্র, আত্মহত্যা ও নিজেকে ঘৃণা করা জাতীয় প্রচারণা বাড়লেও সাধারণ স্কুলশিক্ষার্থীরা এগুলোকে খুব একটা হুমকি মনে করে না। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, দেশের ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি বা উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে। আর একাধিকবার হয়রানির শিকার হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। হয়রানি বা উত্ত্যক্তের কারণে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সতর্ক হতে হবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা প্রয়োজন। যেকোনো মূল্যে শিশু-কিশোরদের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা নিশ্চিত তুলতে পারব তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন আসক্তি কমাতে অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে বকুনি দিয়ে কিংবা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে এ অভ্যাস ঠেকানো যাবে না। বরং এতে বিপরীত হতে পারে।

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ আসক্তদের এসব ডিভাইস ব্যবহারের সময়টি ধাপে ধাপে কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সবার আগে অভিভাবককে দেখতে হবে কেন তার সন্তান অনলাইনে বা অনলাইন গেমে সময় কাটানোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে? শুধু অনলাইন গেম খেলতে কিংবা অনলাইনে থাকতে নিষেধ করলেই হবে না, বিকল্প কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

তা ছাড়া সন্তানের সামনে অভিভাবকদের স্মার্টফোনে মগ্ন থাকা, খাবার টেবিলে স্মার্টফোন দেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে আমরা আমাদের দেশের এই শিশু-কিশোর ভবিষ্যতের সোনালি সম্পদকে মেধাশূন্য জাতির পথে ঠেলে দেব।

ফলে ভবিষ্যৎ জাতির সঠিক কর্ণধার ও জ্ঞানী মানুষের অভাব অনুভব করবে। আর তারা একটা সময় পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের বোঝা হবে। তাই আমরা আমাদের সন্তানদের ওপর নজর রাখা একান্ত নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশলাইভ/এসআর